শেরপুরের ইতিহাস
শেরপুর একটি নাম, একটি অতীত চিত্রের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি ও সর্বোপরি ইহা এক মহাকালজয়ী ঐতিহাসিক প্রাচীন অধ্যায়। ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত এ নামটি কেবল বগুড়া জেলার অত্র স্থানেই সীমাবদ্ধ নহে বরং এছাড়া ও এ নামটির মাহাত্ন্য ও ঐতিহ্য খুঁজে পাওয়া যায় কাশ্মির, আফগানিস্তান, ভারতের বীরভূম ও বাংলাদেশের সিলেট ও ময়মনশাহী জেলাতে। যে মহান ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে, শেরপুর নামের উদ্ভব হয়েছিল, সম্ভবতঃ তিনি হলেন আফগান বালক ফরিদখান । এ বালক বীর পরবর্তীকালে নরখাদক এক বিশালকায় হিংস্র ব্যাঘ্র হত্যা করে, শেরখান নামে অভিহিত হন। তাঁরই নামানুসারে যে কয়টি উল্লেখযোগ্য স্থানকে ঐতিহাসিক ভাষায় পরিচিহ্নিত করেন, বগুড়া জেলার শেরপুর তম্মধ্যে অন্যতম। শেরপুর একটি প্রাচীন নাম । এ নামটি আজ হতে প্রায় চারশ বছর পূর্বে ইতিহাসের পাতায় স্থান লাভ করে থাকবে। খ্রীষ্টীয় ৭ম শতাব্দীতে চিন দেশীয় পরিব্রাজক হিউয়েস্থ সাং প্রাচীন পৌন্ড্রবর্দ্ধনে কালাতো (Kalato) নামে একটি সুবিশাল নদী অতিক্রম করে আসাম রাজ্যে প্রবেশ করেন বলে জানা যায়। হিউয়েস্থ সাংঘ কর্তৃক উল্লেখিত সেই নদীটিই যে আজকের করতোয়া এতে দ্বিমতের কোন অবকাশ নেই।
পুরাতন তন্ত্রাদি সূত্রে জানা যায় যে এক সময় করতোয়া নদীদ্বারা বঙ্গ ও আসাম (কাররুপ) পৃথকৃত ছিল। কাজেই অনুমান করা যায় যে, প্রাচীন বৌদ্ধ আমল হতেই শেরপুরের ঐতিহাসিক পরিচয় সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল।
দিল্লীর সুলতানী আমলে বগুড়া তথা গোটা উত্তর বঙ্গ অনেক বারই সুলতানদের কবলিত হয়েছিল। অভিযান কালে কেউ কেউ শেরপুর ও মহাস্থানকে উপ রাজধানী ও সেনা ছাউনী রূপে ব্যবহার করেছেন। আসাম ও কোচ বিহার অভিযান কালে এ স্থানটি এক শক্তিশালী ঘাটি হিসেবে ব্যবহৃত হতো । কথিত আছে যে আসাম আক্রমণ কালে সেনাপতি মীর মুমলা (১৬৬১) বেশ কিছুদিন শেরপুর ও ভবানীপুরে বিশ্রাম গ্রহন করেন।
আজকের শেরপুর, এক মহানগরীর স্মৃতি বিজড়িত একটি পরিত্যক্ত খন্ড উপশহর মাত্র। পূর্বে এটি ছিল ধনে জনে পরিপূর্ণ এক বিশাল নগরী। অতীতে এ জনপদের প্রশংসায় মুখরিত ছিল সারাটি গাংগের (সাবেক বাংলা) সমগ্র বঙ্গ ভূমি। এ নগরীর খোশ নাম ছড়িয়ে পড়েছিল পাক-ভারত বাংলার পশ্চিমাঞ্চলে, দক্ষিণ ভারতের মালয়ে, সুমাত্রায় জাভায়, ব্রক্ষদেশ শ্যাম আর সিংহলের মত দূর দুরান্তরের দেশে, এমনকি পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তেও শেরপুরের পাশ দিয়ে বয়ে চলছে আজকের ক্ষীণ স্রোতা করতোয়া, কিন্তু আদিতে ছিল এটি করস্রোতা। কথিত আছে যে অধুনা বারদুয়ারী ঘাট এককালে আন্তর্জাতিক মহানদী বন্দর রূপে বিবেচিত হতো। সেকালে এ নদীটির বিস্তৃতি ছিল এখান হতে মেহমানশাহীর শেরপুর পর্যন্ত প্রসারিত। এ নদী দিয়ে বাণিজ্য তরী মালায় সিংহল, সুমাত্রার উদ্দেশ্যে যাত্রা করতো । তেমনি এর বিশাল ঘাটে এসে ভিড়তো ভিন দেশের রকমারি বাণিজ্য তরী।
অধুনা উত্তর বঙ্গ আদিকাল হতে আদি শূরের আমল পর্যন্ত পৌন্ড্রবর্দ্ধন নামেই পরিচি ত ছিল। ৭৩২ খ্রীষ্টাব্দে আদিশূর জয়ন্ত যখন, পঞ্চ গৌড়ের অধিশ্বর হন, তখন হতে পৌন্ড্রদের পরিবর্তে গৌড় দেশ নামে অভিহিত হয়। কিন্তু রাজধানী পৌন্ড্রবর্দ্ধনেই থেকে যায়। অতঃপর তদ্বংশীয় রাজা প্রদ্যুম্নশূর ও বরেন্দ্রশূর যখন একই সময়ে রাজত্ব লাভ করেন, তখন গৌড়দেশ দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। বরেন্দ্র শূরের অধিকৃত খন্ডের নামকরন হয়, বরেন্দ্র দেশ এবং এই অংশেই আমাদের আলোচ্য শেরপুর অবস্থিত।
শেরপুর নাম করনের পেছনে রয়েছে মজবুত ঐতিহাসিক ভিত্তি। বাস্তবে নামকরণ অপেক্ষা ইহার ঐতিহ্যই যে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ এবং সুপ্রাচীন এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে সেই প্রাচীনত্বটি খূজে বেরকরা কেবল দুঃসাধ্যই নয়, বরং রীতমত এক অসম্ভব ব্যাপার । অধুনা শেরপুর অপেক্ষা প্রাগৈতিহাসিক শেরপুর ছিল সর্বাধিক সুপ্রসিদ্ধ। নাম করনের পূর্বেও এ স্থানটি তার নিজস্ব মহিমায় ছিলমূর্তমান। প্রাগৈতিহাসিক এই স্থানটির ভিন্ন কোন কোন নাম ছিল কি-না, তা বলা কঠিন । তবে সেই অজ্ঞাত যুগে যদি স্থানটি উত্তর বঙ্গের প্রবেশদ্বার অথবা বরেন্দ্র তিলক নামে অভিহিত করা হতো, তবে মোটেই বেমানান হতোনা নিশ্চয়।
শেরপুর নামটিই এর সঠিক ঐতিহ্যের অন্যতম প্রকাশক। এ নামটি অবিতর্কিত হলেও এ সম্পর্কে অল্প বিস্তর আলোচনা ও পর্যালোচনা অবকাশ আছে বই কী ? আমাদের এই উপমহাদেশের উল্লেখযোগ্য অনেক ক’টি স্থানই শেরপুর নামে ইতিহাসে স্থান লাভ করেছে বহুযুগে পূর্বে । অন্যত্র যে কারনেই হোক, তবে উত্তর বঙ্গের বগুড়া জেলায় অবস্থিত ঐতিহাসিক শেরপুর নগর যে সম্রাট শেরশাহের নামেই পরিচিহ্নিত ও প্রবর্তিত হয়েছিল এতে দ্বিমতের কোন অবকাশ নেই। আমরা জানিযে, পাঠান নৃপতি শেরশাহ শূরী ছিলেন এক অবিসংবাদিত ও পরম জনপ্রিয় সম্রাট । বাংলার জনগণ তাঁর প্রশংসায় ছিল পঞ্চমুখ। সীমিত সময়ের মধ্যে তিনি এখানকার জনগনের কল্যানার্থ অনেক অনেক উল্লেযোগ্য কাজ করেন। এজন্যই তার সুনামের নজরানা হিসেবে বগুড়া জেলায় এ স্থানটি শেরপুর নামে পরিচিহ্নিত হয়েছে। তদানীন্তন বাংলার পূর্তগীজ গভর্নর ভনডেন ব্রুক কর্তৃক বিরচিত বঙ্গ ভূমির মানচিত্রে, তিনি শেরপুরকে Ceerpoor Mirt অর্থাৎ Sherpur Murcha নামে উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া সমসাময়িক অপরাপর ঐতিহাসিকগন ও এ স্থানটিকে শেরপুর নামেই উল্লেখ করেছেন। সম্ভবতঃ ১৫৪০-১৫৮০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে কোন এক সময় এ স্থানটির নাম করণ হয়ে থাকবে। ঐতিহাসিকগণ অনুমান করেন যে, শেরশাহ অথবা তাঁর কোন সেনাপতি এই নামটি প্রবর্তন করে থাকবেন । কেউ কেউ অনুমান করেনযে ‘সির’শব্দ হতে শেরপুর নামের উৎপত্তি হয়েছে। মধ্য যুগীয় অনেক গ্রন্থে শেরপুরের স্থলে সেরপুর উল্লেখিত হয়েছে। সম্ভবত তারা ‘সির’ শব্দকেই অনুসরণ করে থাকবেন। কারণ, হয়রত শাহ্ তুরকান শহীদের সির বা মস্তক এখানেই সমাধিস্থ হয়েছে এবং শেরপুরের মুসলীম ইতিহাসে তা যে কোন উল্লেখযোগ্য হলেও আদৌ গ্রহন যোগ্য নয়। কারন, ‘সির’ শব্দটির রূপান্তর সিরমোকাম ও সেরুয়া গ্রামের নামেই সীমাবদ্ধ, এর বাইরে নয়। অন্যকথায় শেরপুর নামের উৎপত্তি অন্য কোন শব্দ হতে হয়নি বরং হয়েছে শেরশাহ্ এবং একমাত্র শেরশাহ্ নাম হতেই।
এ স্থানের অপর দুটি শ্রুত নাম সোণাপুর ও ‘‘বার দুয়ারী’’ লোকমুখে শোনা যায়। কথিত আছে যে খ্রীষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে তৎকালে নাটোর রাজগণ, তাঁদের সুবিস্তীর্ন জমিদারী গঠন করে তুলেছিলেন এবং তারা এখানে বার দুয়ারী নামে একটি তহসীল কাছারী স্থাপন করে ছিলেন। তাইতো এর অপর নাম বারদুয়ারী শেরপুর। সোণাপুর সম্পর্কে জনশ্রুতি ব্যতীত অন্য কোন প্রমাণ উল্লেখ করা সম্ভব নয়। বলা হয়ে থাকে যে, সেকালে একবার এখনে প্রচুর স্বর্ণ সম্পদ পাওয়া গিয়েছিল অথবা এস্তানটি এক সময় প্রাচ্যের স্বর্ণ ব্যবসায় কেন্দ্রে পরিনত হয়েছিল। তাই একে সোনাপুর নামে আখ্যায়িত করা হয়। কেহ কেহ ‘‘সোনাভান’’ পুথি কেতাবে উল্লেকিত সোণাপুরকে শেরপুরের আদিনাম বলে কল্পনা করেন। কোন কোন বিজ্ঞ ব্যক্তির মতে শের (ব্যাঘ্র) শব্দ হতে শেরপুর নামের উৎপত্তি হয়েছে। কারণ এককালে এখানকার জংগলে অসংখ্য ব্যাঘ্র বাস করতো। বস্ত্তুতঃ নাম করনের এসব অবতারণা, কথার কথা বই আর কিছুই নহে।
অধুনা শেরপুর মূল শহরটি প্রাচীন পরিখা বরাবর অবস্তান করছে। অধুনা সির মোকাম হতে শুরু হয়ে নদীর পশ্চিম তীর বরাবর মির্জাপুর পর্যন্ত প্রাচীন সেই মোর্চা বা পরিখাটি প্রলন্বিত ছিল। কথিত আছে যে তদানীন্তন দক্ষিণ বঙ্গের বার ভৌমিকের অন্যতম ব্যক্তিত্ব, যশোহরের প্রতাপাদিত্য কে শায়েস্তা করনার্থই শেরপুরের উল্লেখিত দুর্গটি নির্মিত হয়েছিল। তৎকালে, বর্তমান পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার অধিকাংশ স্থানই যশোহর জেলার অর্ন্তভূক্ত এবং উহা রাজা প্রতাপাদিত্যের শাসনাধীন ছিল। মূলতঃ রাজাপ্রতাপাদিত্যকে বশীভূত করার জন্যই মুঘল সেনাধ্যক্ষ এখানে আস্তানা গড়ে তুলেছিলন।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সেকালে মেহমান শাহী পরাগণার সদর দপ্তর বা হেড কোয়ার্টাার মোর্চা শেরপুরেই অবস্থিত ছিল। এই শেরপুর মোর্চার অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন ও বিতর্ক তুলেছেন, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস লেখক, শ্রীযুক্ত নিখিলনাথ রায় মহাশয় । তিনি উল্লেখ করেন’’ আইনে আকবরীর সেরপুর মুর্চা, ময়মনসিংহ, বগুড়া বা মুর্শিদাবাদের সেরপুরের মধ্যে কোন্টি তাহা স্পষ্ট বুঝা যায়না’’। তিনি শেরপুর মোর্চা কে মুর্শিদাবাদের অর্ন্তভুক্ত করে দেখাতে চান। কিন্তু আইনে আকবরীতে দেখা যায় যে, উহা মেহমানশাহী পরগনায় অবস্থিত এবং বগুড়া জেলার অন্তর্গত । গ্লাড উইন অনুদিত আইনে আকবরীতে লিখিত হয়েছে’’
Mehman shahy, Commonly called sherpur Murcha” অর্থাৎ মেহমান শাহীকে সাধারণ্যে শেরপুর মোর্চা বলা হয়ে থাকে । সুতরাং নিখিল বাবুর অনুমান মোটেই গ্রহনযোগ্য নয়।
ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে প্রাচীন শেরপুর মোর্চা সেকালে এক মহাসমর ক্ষেত্রে পরিনত হয়েছিল । এখানে মানসিংহের সহিত দুর্ধষ আফ্গানদের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এ যুদ্ধের বিবরণ মুর্শিদাবাদের ইতিহাসের ভাষায় নিম্নরুপঃ ‘‘উড়িষ্যা হইতে মোগল দিগকে বিতাড়িত করিয়া আফগানেরা বাঙ্গালা পর্যন্ত ধাবিত হয়। ........... সেই সময় বিশ হাজার আফগান, ওস্মানের পতাকা মূলে সমবেত হইয়াছিল। সেরপুর মুর্চার পশ্চিম প্রান্তরে উভয়পক্ষের ঘোরতর সংগ্রাম বধিয়া উঠে । আফগানদিগের সহিত বহু সংখ্যক রনহস্তী ছিল। সর্বাগ্রে সেই সমস্ত মদোন্মত রণহস্তী স্থাপিত হইলে, মোঘল ও রাজাপুতগণ তাহাদের প্রতি গোলা বৃষ্টি আরম্ভ করায়, হস্তীগণ বিকট আর্তনাদ করিতে করিতে ছত্র ভংগ হইয়া পড়ে এবং আফগানগণও উপর্যু্যপরি আক্রান্ত হইয়া পলায়ন করিতে বাধ্য হয়। মোগল ও রাজপুতগণ কয়েক ক্রোশ পর্যন্ত তাহাদের পশ্চাৎধাবন করে, তাহারা উড়িষ্যা মুখে অগ্রসর হয়’’। মেরচা শব্দটি শেরপুর নামের বহুল প্রচলিত অবিচ্ছেদ্য অংশ। এক কালে মোর্চা ব্যতীত শেরপুর নাম অবোধ গম্য ছিল। এই শেরপুরে আমরা আরও তিনটে মোর্চার উল্লেখ দেখতে পাই যথা, গ্রাম মোরচা, বন মোরচা ও পান মোরচা। শেরপুরের দক্ষিণ পূর্বাংশ গ্রাম মোরচা, মধ্যাংশ পান মোরচা ও উত্তর পশ্চিম প্রান্তে বন মোরচা অবস্থিত। শেরপুরের দক্ষিণ ও পূর্বাংশ সৈয়দপুর এবং উত্তর ও পশ্চিমাংশ উলিপুরের অন্তর্গত।
অধুনা শেরপুর শহরটি ধ্বংসাবশেষের অবশিষ্টাংশ মাত্র। এককালে এ শহরটির বিস্তৃতি ছিল দৈর্ঘে ও প্রন্থে যথাক্রমে বার ও ছয় মাইল। প্রাচীন মূল শহরের সর্বাংশই এখন সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে। মূল শহরটি কিরুপে এবং কখন যে ধ্বংশ প্রাপ্ত হয়েছে, তার বিশদ বিবরণ সম্পূর্ণরুপে অনুপস্থিত। বিশেষ ভাবে অনুধাবন ও অনুমান করা যায় যে প্রাচীন টোলা, মিঞা টোলা, পাঠান টোলা ও ধড় মোকাম প্রভৃতি এককালে শহরের উল্লেখযোগ্য মহল্লা রূপে পরিগণিত হতো। এখানে অবস্থিত সুপ্রসিদ্ধ টোলা মসজিদ খেরুয়া, মসজিদ ও বিবির মসজিদ প্রায় একই সময় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে প্রমান পাওয়া যায়। একই মহল্লায় একাধিক বৃহদাকার মসজিদের অস্তিত্ব দেখে সহজেই অনুমান করা যায় যে, সেকালে এ স্থানটি ছিল মুসলীম জনবহুল এলাকা। অধুনা শেরপুর শহরটি প্রাচীন মূল নগরীর অবিচ্ছেদ্য অংশ কিনা তা নির্ণয় করা কঠিন। তবে এ শহরটির প্রাচীনত্ব ও নেহাত কম নয়। সম্ভবতঃ মূল প্রাচীন নগরীর পতনের পর পরই এটি দ্বিতীয় মূল শহর হিসেবে গড়ে উঠে থাকবে। সংগত কারনেই এক সময় শেরপুরকে ‘‘উত্তর বঙ্গের প্রাচীন দিল্লী’’ নামে অভিহিত করা হতো। কারন তখনকার দিনে কেবল শেরপুর, বোয়ালিয়াও ঘোড়াঘাট নামেই উত্তর বংগের অস্তিত্ব বুঝানো হতো। ১৮২১ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বপর্যন্ত শেরপুর ও মহাস্তান ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থান। লুটেরা দস্যুদের নৈরাজ্য রোধের জন্য তদানীন্তন ইংরেজ বেনিয়া সরকার, বগুড়া নামে আর একটি পৃথক জেলা সৃষ্টি করতে বাধ্য হয়। বলা হয়ে থাকে যে, সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবনের পুত্র বাংলার শাসন কর্তা নাসির উদ্দিন বগরা খানের নামানুসারেই নবগঠিত এই জেলার নামকরণ হয়েছিল। বগুড়ার পরিবর্তে যদি শেরপুরে জেলা সদর প্রতিষ্ঠা করা হতো, তাহলে ইহার ঐতিহ্য চির কাল অক্ষুন্ন থেকে যেতো বই কী। জেলা গঠনের পর স্বাভাবিক ভাবেই প্রশাসনিক মর্যাদায় শেরপুর দ্বিতীয় স্থানীয় হয়ে পড়ে। মুঘল যুগে শেরপুরছিল সুপ্রসিদ্ধ এক সীমান্ত ঘাটি। ১৭৬৫ ঈসায়ী থেকে মুঘল সম্রাটদের নিকট হতে ইংরেজ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পনী বিহার উড়িষ্যার দেওয়ানী সহ এই অঞ্চল ও করলগত করে ফেলে। উত্ত বঙ্গের অমর প্রতীক হিসেবে শেরপুরের মর্যাদা ছিল সমূন্নত কিন্তু ঢাকায় মুসলমান শাসনাধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে, ইহার প্রাধান্য বহুলাংশে লোপ পায় । (২) মুঘল আমলে শেরপুর বিদ্রোহীদের এক মহা মিলন কেন্দ্রে প্ররিণত হয়েছিল, কারণ সম্রাট আকবর কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ের পর বিদ্রোহী কাকশাল গোত্রের লোকেরা এখানে শক্তিশালী আস্তানা গড়ে তুলেছিল।
প্রসিদ্ধ টোলা চৌহদ্দির অন্তর্গত বিভিন্ন স্থানে মাটি খনন কালে অনেক প্রাচীন ঘর বাড়ীর ধ্বংসাবশেষ আবিস্কৃত হয়েছে। কয়েক স্থানেখনন কালে শেরশাহী আমলের রৌপ্য মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। টোলা মহল্লার পুর্বাংশে অবস্থিত হামছায়াপুর গ্রামটি অপেক্ষাকৃত অধিক প্রাচীন বলে অনুমিত হয়। মুঘল আমলে ইহা পাটান টোলা নামে পরিচিত ছিল। সেকালে এখানে সরকারী তহসীল কাছারী প্রতিষ্ঠিত ছিল বলে জনশ্রুতি আছে। পরবর্তী কালে প্রলয়ংকরী ভূমিকল্প অথবা অন্য কোন দৈব দুর্যোগে পাঠান টোলার ঘরবাড়ী ধ্বংস প্রাপ্ত হলে স্থানটি গভীর অরণ্যে পরিণত হয়। অতঃপর অরণ্যের কোন কোন অংশে বুনো বা সাঁওতাল শ্রেণীর লোকজন বাস আরম্ভ করে। পরিশেষে ১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দে আসাম হতে আগত বাস্তহারাগণ এখানে পুনর্বাসন লাভ করলে, পাঠান টোলারঅরণ্য সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ হয়ে যায়। এখানে চাষাবাদ ও ঘর গৃহ নির্মাণকালে টোলা ও পাঠান টোলার এখানে ওখানে অনেক প্রাচীন কীর্তি যথা, দালান কোঠার ধ্বংসাবশেষ, মৃৎশিল্পের নমুনা, ধনুক যুদ্ধে ব্যবহৃত মৃত্তিকা বর্তুল, তসবি্হ দানা ঘটি বাটি, কড়ি মুদ্রা, বৌদ্ধ মৃর্তি প্রভৃতি বহুল পরিমানে পাওয়া গিয়েছে। সম্ভবতঃ অধুনা হামছায়াপুর বিশেষতঃ বর্তমান ইতিহাস প্রণেতার বাসভবন সংলগ্ন স্থান সমূহ সেকালে এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ মহল্লা ছিল বলে মনে হয়। কারণ এ অংশের মৃত্তিকায় প্রাচীন উপাদান এত বেশী অবশিষ্ট রয়েছে যা দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে চাষাবাদ করার পরও দূরীভূত হয়নি। এখানে প্রাপ্ত ছোট বড় মৃত্তিকা বর্তুল দৃষ্টে মনে হয় যেন এক কালে এ স্থানটি কোন সমরক্ষেত্র অথবা অস্ত্র নির্মাণ কারখানা রূপে ব্যবহৃত হতো।
অধুনা শহরটি প্রাচীন শেরপুরের ভাংগা গড়ার পঞ্চম সংস্করণ বটে। ইতোপূর্বে এই শহরটি কমপক্ষে চার বার চুড়ান্ত ধ্বংসাবস্থা প্রত্যক্ষ করেছে । পরিশেষে আজকের শেরপুর দূর অতীতের স্মৃতি বক্ষে জুড়ে ক্ষুদ্রতম পরিসরে মহাকালের স্বাক্ষররূপে দাঁড়িয়ে আছে।
বৃহত্তর বগুড়ার জয়পুরহাট মহকুমা, অতঃপর জেলা শহরে রূপান্তরিত হওয়া পর্যন্ত শেরপুর ছিল দ্বিতীয় মর্যাদাশীল এক ঐতিহাসিক শহর। এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব এখনও অনুধাবন যোগ্য। শেরপুর এক সময় দালান বা কোঠা বাড়ীর শহর বলে আখ্যায়িত হতো। জমিদারী আমলে এখানে এত সংখক দ্বিতল, ত্রিতল প্রাসাদ তৈরী হয়েছিল যে, এগুলি নির্মাণ কল্পে অসংখ্য রাজমিস্ত্রিকে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে হতো এবং উক্ত মহল্লাটি পরবর্তী কালে মিস্ত্রি পাড়া নামে অভিহিত হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে ঐ প্রাসাদমালা দীর্ঘ স্থায়ী হতে পারেনি-কারণ, বঙ্গাব্দ ১২৯২ সালে (৩০শে আষাঢ়, পূর্বাহ্ন ৬ ঘটিকা) সংঘটিত এক সর্বনাশা ভূমিকম্পে এ শহরের বর্ননাতীত ক্ষতি সাধিত হয় এবং এর ফলে জনপদের বিশাল সংখ্যক মানুষ দালান চাপা পড়ে প্রাণ ত্যাগ করে।
ভুমিকম্পের পুর্বে শেরপুর ছিল এক সুশোভিত জন পদ। এই তান্ডব লীলায় যে অপূরণীয় ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল, তার বিশদ বিবরণ পেশ করা কঠিন । উক্ত মহাদুর্যোগের ফলে একমাত্র শেরপুর শহরেই ৪৫/৫০ জন লোকের প্রাণ হানি ঘটে। যারা এ সর্বনাশা তান্ডবে নিহত হয়েছেন, তম্মধ্যে মুন্সী বাটির শ্রীযুক্ত রাধা বমন মুনসীর বড়স্ত্রী, চন্দ্র কিশোর মুনসীর চতুর্থ পুত্র, কালি কিশোর মুনশী মহাশয়ের মাতা ও চার সন্তানসহ অত্র পরিবারের নিজস্ব মোট আঠার ও অপরাপর আরও এগার জনের প্রাণ হানি হয়। এতদ্ব্যতীত এখানে অবস্থিত শ্রী জগন্নাথ দেবের মন্দির সহ আরও অনেক গুলি অতি প্রাচীন মন্দির ও দেবালয় ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।
পুর্বেই উল্লেখিত হয়েছে যে মোরচা শেরপুর কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা বলা কঠিন। অনেকে অনুমান করেন যে করতোয়া নদী যখন এখান হতে মেহমানশাহী পর্যন্ত সুবিস্তৃত ছিল এবং কামরূপ (আসাম) কে যেকালে করতোয়া নদী দ্বারা বঙ্গ ভুমি হতে বিভক্ত ও পৃথক করা হতো সেই আমলে এই নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কেহ কেহ মত পোষন করেন যে, জৌন গনই এখানে সর্ব প্রথম প্রতিষ্ঠা লাভ ও নগর পত্তন করেন। কিন্তু অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে বৌদ্ধগণই সর্বাগ্রে এ শহরের গোড়া পত্তন করেন। সম্ভবতঃ বৌদ্ধ যুগেই করতোয়া এখন হতে ময়মনসিংহ পর্যন্ত বিস্ত্তৃত ছিল এবং সেই বিশাল নদীটি পার হতে তখন মাথাপিছু খেয়া মাগুল দশকাহন প্রয়োজন হতো । সে আমলের এ বিবরনটুকু ব্যতীত আর কোন তথ্য উদ্ধার করা যায়নি। অনুমান করা যায় যে, বৌদ্ধ শাসনামলের শেষের দিকে বল্লাল সেন তখনকার প্রাচীন কমলাপুর বা রাজবাড়ী মুকুন্দে এক নতুন হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। নবপ্রতিষ্ঠিত সেই সেই রাস্ট্রের সুবিধালাভের জন্য স্বাভাবিক ভাবেই বিভিন্ন স্থান হতে হিন্দু প্রজাগণ এখানে এসে বসবাস শুরু করে। কিন্তু পরবর্তীকালে সেন বংশের পতনের পর যখন মুসলমান প্রভাব বিস্তার হতে থাকে, তখন হিন্দু গন অধূনা শেরপুরে প্রত্যাবর্তন করে। অধুনা বারদুয়ারী ঘাট তৎকালে আন্তর্জাতিক নদী বন্দর রূপে ব্যবহৃত হতে। বানিজ্যিক সুবিধা ছাড়াও আবাসিক সুযোগ সুবিধায় উৎসাহী লোকেরা সহজেই আকৃষ্ট হয়ে পড়তো। ফলে নানা শ্রেণীর লোকজন এখানে এসে স্থায়ী বসতি স্থাপন করে বসে। লক্ষ্যনীয় যে মোর্চা উত্তর উপ-শহরে এককভাবে হিন্দুগণই অধিবাসী হয়। অথচ তখনকার দিনে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যা নেহাত কম ছিলনা। সম্ভবতঃ মুসলমানদের অধিকাংশই তখন কৃষি কাজে লিপ্ত থাকতো হেতু শহরমুখী হতে পছন্দ করতোয়া শহরটি (শেরপুর) বিপুল সংখ্যক হিন্দু পরিবারের বাসস্থল হলেও এর চতুস্পার্শ্বস্থ এলাকা সমূহ মুসলমানদের পবিত্র স্থান দ্বারা পরিবেষ্টিত। সুতরাং এটা মোটেই অমূলক নয় যে, প্রাচীন মোর্চা নগরীর বিস্তৃতি ছিল সুবিশাল এবং এর মুসলিম নাগরিকদের সংখ্যা ছিল বেশুমার।
অধুনা শেরপুর গন্ডির আদি বাসিন্দা কারা, তা সঠিক করে বলা কঠিন । তবে অনেকেই তিলিদেক এখানকার আদি বাসিন্দা বলে অভিমত প্রকাশ করে থাকেন। কারণ, তিলিগন দক্ষ ব্যবসায়ী । তাই এরা বিভিন্ন স্থান হতে এসে অত্র বাণিজ্য কেন্দ্রে স্থায়ীভাবে বসবাবস আরম্ভ করে। অধুনা শেরপুর এক সময় ছিল মুসলমান শূন্য জনপদ । অন্য কথায় হিন্দুগন এবং তাদের মধ্যে ব্রাক্ষণ, তিনি, সৌগন্ধ বনিক প্রভৃতি গোষ্ঠিই ছিলেন এখানকার দন্ডমুন্ডের অধিকর্তা।
তিলিদের আগমনের সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায়না। সুতরাং এ থেকে অনুমান করা যায় যে অপরাপরদের চেয়ে এরা বহুগুণে প্রাচীন বাসিন্দা। এদের আদিত্বের অনুকুলে আরও বলা যেতে পারে যে তিলিদের মধ্যে বড় বাড়ী ছোট বাড়ী ও কুঠি বা কোঠা বাড়ী নামে বহুপ্রাচীন কাল হতেই এরা প্রসিদ্ধি লাভ করে আসছেন। সুতরাং তিলিরাই যে অধুনা শেরপুরের আদিম বাসিন্দা, তাতে সন্দেহের কিছুমাত্র অবকাশ থাকেনা। শেরপুরের তিলিরা সাধারনতঃ দু’ মহল্লায় বিভক্ত ছিলেন যথা, দাস পাড়া ও মহাস্তানপট্রি।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস